শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫০ পূর্বাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক:
মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে মানব পাচার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি অপরাধী চক্র।এ চক্রে যুক্ত এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টেই লেনদেন হয়েছে প্রায় ৩১ কোটি টাকা।কক্সবাজারের টেকনাফ থানার মৌলভীপাড়ার বাসিন্দা জাভেদ মোস্তফা ও তার ভাই মোহাম্মদ আছেম এ চক্রের গডফাদার।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সম্প্রতি জাভেদ ও তার সহযোগীদের ব্যাংকিং হিসাব নম্বর নিয়ে তদন্তের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে।এতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,জাভেদের বিভিন্ন হিসাব নম্বরে প্রায় ৩১ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শত শত ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থেকে তার এবি ব্যাংকের টেকনাফ শাখার হিসাব নম্বরে ২৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।একই ব্যাংকের একই শাখায় তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মেসার্স সাগর পাড় ফিশিংয়ের হিসাব নম্বরে লেনদেন হয়েছে আরও দুই কোটি ৭৪ লাখ টাকা।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,জাভেদের বাহ্যিক ব্যবসায়ের ধরনের সঙ্গে তার হিসাব নম্বরের কোটি কোটি টাকার লেনদেন কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।এ ব্যাপারে জাভেদ মোস্তফার বক্তব্য জানতে তার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা ও পুলিশ সদর দপ্তর হয়ে বিএফআইইউর এই প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে পুলিশের বিশেষ অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কার্যালয়ে।প্রতিবেদন পাওয়ার পর সিআইডি এ সংক্রান্ত তদন্ত শুরু করেছে।
তদন্তে এরই মধ্যে উঠে এসেছে জাভেদ মোস্তফা ও আছেম ছাড়াও আরও ১০ সহযোগীর নাম।শিগগির ফৌজদারি মামলা করা হবে তাদের বিরুদ্ধে।এ ব্যাপারে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন,মানব পাচারকারী সিন্ডিকেটের গডফাদার হিসেবে জাভেদ ও তার ভাই আছেম অনেক দিন ধরেই সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে আসছে।কর্মসংস্থানের জন্য মানুষের বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নকে পুঁজি করে তারা যেভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তা সত্যি বিস্ময়কর।এই চক্রের সবাইকে আইনের আওতায় নেওয়া হবে।
সূত্র জানাচ্ছে,২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জাভেদ মোস্তফা সাগরপাড় ফিশিংয়ের কর্ণধার হিসেবে টেকনাফের এবি ব্যাংকের শাখায় একটি হিসাব নম্বর খোলেন।২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা জমা হয়।বর্তমানে সেখানে ছয় হাজার ৩৮২ টাকা রয়েছে।বাকি অর্থ তুলে ফেলেছেন জাভেদ।হিসাবটিতে অধিকাংশ জমা নগদে সম্পন্ন করেছেন মো.ফোরকান,মিজান,মুজাহিদুল ইসলাম,ওসমান বিল্ডার্স,জুবায়ের,মাঈনউদ্দিন,মিজানুর রহমান,সাইফুর রহমান,রিয়াজ,আলী হোসেন মালিক,লোকমান,মো.হাসান ও মামুন।এ ছাড়া জাভেদ মোস্তফা ২০১২ সালের ৭ জুন টেকনাফের এবি ব্যাংকের শাখায় আরেকটি চলতি হিসাব নম্বর খোলেন।
২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত সেই হিসাব নম্বরে চার কোটি দুই লাখ টাকা জমা হয়।পরে সমপরিমাণ অর্থ সেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়।গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৫ মার্চ এ হিসাব নম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয়।জাভেদ মোস্তফার আরেকটি হিসাব নম্বরে ২০১১ সালের ১৫ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জমা হয়েছে।পরে জাভেদ সেই অর্থ তুলে ফেলেন।জাভেদ তার আয়ের উৎস হিসেবে আমদানি-রফতানি ব্যবসার কথা বলে থাকেন।
তবে তদন্তে বলা হয়েছে,হিসাব নম্বরের লেনদেনের সঙ্গে তার ব্যবসা সামঞ্জ্যপূর্ণ নয় বিএফইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,পেশা হিসেবে জাভেদ ফিশিং ও আমদানি-রফতানির কথা বললেও দেশের বিভিন্ন হিসাব নম্বর থেকে তার অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর হওয়ার বিষয়টি সন্দেহজনক।বিভিন্ন ব্যাংকের নিউ এলিফ্যান্ট রোড,ইমামগঞ্জ,মতিঝিল,টেকনাফ,নর্থ-সাউথ
রোড,বনানী,মহাখালী,ফেনী,কক্সবাজার,বেনাপোল,বরিশাল,সাতক্ষীরা,মাধবদী,চাঁদপুর,কুমিল্লা,নবাবপুর,রোকেয়া সরণি,উত্তরা,কাকরাইল,মিরপুর,গুলশান,খাতুনগঞ্জ,বহদ্দারহাট,মালিবাগ ও ফকিরাপুল শাখা থেকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি জাভেদ মোস্তফার হিসাব নম্বরে অর্থ পাঠিয়েছেন।সিআইডির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে,মানব পাচারে জাভেদের সঙ্গে আরও যারা জড়িত রয়েছে তাদের সবার বিস্তারিত নাম-পরিচয় পেয়েছে তদন্ত সংস্থা।তাদের মধ্যে শীর্ষ ১০ জনের বিরুদ্ধে শিগগির মামলা হচ্ছে।কক্সবাজার কেন্দ্রিক মানব পাচারকারী হিসেবে ৩৫৮ জনের যে তালিকা করা হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম গডফাদার হলেন জাভেদ মোস্তফা ও তার ভাই আছেম।মানব পাচারের পাশাপাশি ইয়াবা ব্যবসা ও অন্যান্য চোরাচালানের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে তারা।সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন বলেন,জাভেদ মোস্তফা ও তার বিশ্বস্ত সহযোগীদের অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন।তাদের অনুসন্ধান করা হচ্ছে।একাধিক সূত্র জানিয়েছে,জাভেদ মোস্তফার বাবা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ও ভাই মোহাম্মদ খোবায়েদ দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় রয়েছেন।
মালয়েশিয়া থাকার সুবাদে আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী গ্রুপের সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে।তেজগাঁও কলেজের বিবিএর শিক্ষক আছেম ২০১০ সালে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়।জাভেদ ও আছেম মানব পাচারের জন্য প্রথমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দালাল নিয়োগ করে।সারাদেশে একটি নেটওয়ার্কও তৈরি করে।মানব পাচারের ঘটনায় বনানী থানার একটি মামলায় গত ১৪ আগস্ট আছেমকে গ্রেফতার করে সিআইডি।এরপর তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।১৯ আগস্ট জামিন হয় আছেমের।এরপর তাকে আরেকটি মামলায় গ্রেফতার করে সিআইডি।পরে ২০ আগস্ট তার আবার জামিন হয়।
তার বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানায় মানব পাচার এবং প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা রয়েছে।উল্লাপাড়া থানার ওসি দেওয়ান কৌশিক আহমেদ বলেন,মানব পাচারের একটি মামলায় আছেম চার্জশিটভুক্ত আসামি।মামলাটি এখন বিচারাধীন।একটি প্রভাবশালী গ্রুপ এরই মধ্যে জাভেদ ও তার ভাইয়ের ব্যাপারে নানাভাবে দেন-দরবার শুরু করেছে।মানব পাচারের অভিযোগ থেকে তাদের মুক্ত করতে চাইছে এ গ্রুপ।তবে তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে,কোনোভাবেই তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না দায়িত্বশীল সূত্র জানাচ্ছে,মানব পাচারের সঙ্গে জাভেদ ও তার পুরো পরিবার জড়িত।জাভেদের ভাই আছেম ‘এসিএস কর্পোরেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন।এভাবে তিনিও প্রায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।সিআইডির তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী,সব মিলিয়ে জাভেদ ও আছেম এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা মানব পাচার করে এখন পর্যন্ত ৩০ কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছে।তবে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন এ অর্থ শতকোটি টাকা হবে।
Leave a Reply